সোমবার, ৩ মার্চ, ২০১৪


নতুন বছরের প্রথম ৪৬ দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৪৬ 04 Mar, 2014
দেশ-বিদেশে তুমুল সমালোচনা সত্ত্বেও ‘বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। গত দেড় মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৪৬ জন। আর ২০১৩ সালে দেশে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা ছিল ২০৮ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যšত্ম সময়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ৪৬ জন। এর মধ্যে র‌্যাবের হাতে ১৫ জন, ২২ জন পুলিশের হাতে, ১ জন র‌্যাব ও পুলিশের (যৌথভাবে) হাতে, ১ জন বিজিবির হাতে এবং বাকি ১৬ জন যৌথবাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- শুরু হয় ২০০৪ সালে এলিট ফোর্স র‌্যাব গঠনের পর থেকে। এরপর ২০০৫ ও ২০০৬ সালে এ ধরনের হত্যাকা-ের শিকার হয় ৭৩৯ জন। ওই সময় প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এ ধরনের হত্যাকা-ের জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কঠোর সমালোচনা করছিল। বলেছিল, তারা ক্ষমতায় আসলে ‘বন্দুকযুুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করা হবে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার একইভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার কমপক্ষে ২২৯ জন। আসকের তথ্যানুযায়ী, ২০০৬ সালের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনা সবচেয়ে কম হয়েছে ২০১২ সালে। ওই বছর ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে ৯১ জন। এছাড়া ২০০৪ সালে ২১০ জন, ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন, ২০০৬ সালে ৩৬২ জন, ২০০৭ সালে ১৮০ জন, ২০০৮ সালে ১৭৫ জন, ২০১০ সালে ১৩৩ জন এবং ২০১১ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে ১০০ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে ক্রসফায়ার নতুন নাম পায় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামে। ওই বছর এ ধরনের হত্যাকা-ের শিকার হয় ২০৮ জন। অভিযোগ রয়েছে, গত ১০ বছরে দেশে বহুসংখ্যক মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম হয়েছে। তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে হঠাৎ করেই ‘ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এটা আইন ও গণতন্ত্র পরিপন্থী এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধে এর সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শা¯িত্ম দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এদিকে পুলিশ প্রধান আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার দাবি করেছেন, গুম-হত্যা নতুন কোনো বিষয় নয়। আগে থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে। একইভাবে এখনো চলছে। তবে এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদা তৎপর উল্লেখ করে পুলিশের এই মহাপরিদর্শক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ধরনের অপরাধ দমনে অপরাধীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে এবং তারা সফলভাবে তাদেরকে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ে আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তিনি বলেন, তদšত্ম করে কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অধিকাংশ অভিযোগ থেকে জানা যায়, বেশির ভাগ ক্রসফায়ারের ঘটনা এক পক্ষের। এটি পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। ক্রসফায়ারের কথা বলা হলেও সেখানে বিপরীত পক্ষের কোনো অ¯িত্মত্ব পাওয়া যায় না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এই ধরনের ভূমিকা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখ গেছে, অপহরণ বা গুম করার ক্ষেত্রে অপহরণকারীরা নিজেদেরকে র‌্যাব বা ডিবি পুলিশ বলে পরিচয় দিচ্ছে। আর এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছেন সাধারণত শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতারা। এদের মধ্যে কারো কারো মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ পুরোপুরি গুম হয়ে যাচ্ছে। তাদের আর কোনো খোঁজ মিলছে না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য হচ্ছে, যাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে তাদের সবাই অপরাধী। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দাবি, যখন তাদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে তখন আত্মরক্ষার্থে তারাও পাল্টা আক্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সালাউদ্দীন (২৯) এবং জুয়েল (২৮) নামে দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছিল। এদের মধ্যে সালাউদ্দীন ৮টি হত্যা মামলার আসামি হলেও জুয়েলের বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রাšত্ম কোনো রেকর্ড পুলিশের কাছে নেই। তিনি কাপ্তান বাজার এলাকায় ভাঙারির ব্যবসা করতেন। যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশের কাছে তথ্য জানতে চাওয়া হলে তারা জুয়েলের বিরুদ্ধে কোনো মামলার কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। এমনকি কোনো সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) নেই তার বিরুদ্ধে।এ ব্যাপারে পুলিশের ডেমরা বিভাগের সহকারী কমিশনার মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, জুয়েল কোনো মামলার আসামি নয় এটা ঠিক। কিন্তু সালাউদ্দীন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পৃথক তিনটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জুয়েলের নাম বলেছে। জুয়েল সম্পর্কে জানতে চাইলে শনির আখড়া এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, তিনি সন্ত্রাসী সালাউদ্দীনের নাম শুনেছেন। তবে জুয়েলের নাম কখনো শোনেননি। জুয়েল নামের কোনো অপরাধী বা সন্ত্রাসীর নাম এই প্রথম শুনলেন বলে জানান তিনি। এদিকে মামলার তদšত্ম কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশের এসআই প্রদ্বীপ কুমার কুন্ডুর কাছে জানতে চাইলে তিনিও জুয়েলের বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রাšত্ম কোনো ডকুমেন্টস দেখাতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, কোনো ব্যক্তি গুম বা নিখোঁজ হলে পরিবারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় এ সংক্রাšত্ম অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগের বেশির ভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে করা হচ্ছে। তারা যদি কিছু না করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠছে কেন? তিনি মনে করেন, এ ধরনের গুম ও হত্যাকা- বন্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পারস্পারিক সহযোগিতা দরকার। এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি নিখোঁজ হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভাটার শাখার সাংগঠনিক সম্পাদিক তানভীর হাসান অঞ্জন। এ বিষয়ে থানায় কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করা হলেও এখন পর্যšত্ম র‌্যাব, পুলিশ ও ডিবি তার কোনো হদিস দিতে পারেনি। এছাড়া গত বছরের ৪ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান রানা, মাজাহারুল ইসলাম এবং আলামিন রাজধানীর বারিধারা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ঘটনার পরপরই রানার বোন মিনারা বেগম মুগদা থানায় এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু পুলিশ এখনো রানার কোনা সন্ধান দিতে পারেনি। নিখোঁজ এই তিনজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, তারা ওই তিনজনকে ছাত্রদলের নেতা হিসেবে জানে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা বা ওই এলাকায় অপরাধী কর্মকা-ে জড়িত থাকার ব্যাপারে তারা কখনো কোনো কিছু শোনেনি। ঢাকা ট্রিবিউন উৎসঃ আমাদের সময় Share on facebook Share on email Share on print

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন