সুন্দরী চিত্রনায়িকা এখন নামাজ শিক্ষা বই বিক্রেতা
রাজধানীর
মোহাম্মদপুর থেকে বাসে করে প্রেসক্লাবের দিকে আসছিলাম। তখন ছিল ভর দুপুর।
ভ্যাপসা গরম। ডিইউজে এবং বিএফইউজে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছিলাম একটু
অন্যমনস্ক। বাসে হঠাৎ নামাজ শিক্ষা বই বিক্রেতা একটি নারী কণ্ঠ শুনে চমকে
উঠলাম। তার দিকে তাকাতেই দেখলাম পুরো শরীর বোরখায় ঢাকা। শুধু মুখের নেকাবটা
সরানো। কণ্ঠটি খুব পরিচিত মনে হলেও চেহারা তেমন একটা মিলাতে পারছিলাম না।
কে এই নারী? তিনি খুব মনোযোগের সঙ্গে বই বিক্রয়ের যাবতীয় কথা আওড়িয়ে
যাচ্ছিলেন। এক সময় তার চোখ পড়ল আমার ওপর। এগিয়ে এসে বললেন, ‘হ্যাঁ আমি
বনশ্রী।’ একথা বলেই মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে তিনি চলে গেলেন। ঘটনার
আকস্মিকতায় পাশের লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি চলে গেলাম বেশ কয়েক
বছর পেছনে।
সুন্দরী তম্বী এই নায়িকাটিকে নিয়ে
প্রযোজক, পরিবেশক ও প্রদর্শক ফারুক ঠাকুর খ্যাতিমান নির্মাতা মমতাজ আলীকে
দিয়ে সে সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি সোহরাব রুস্তম নির্মাণ করেছিলেন।
ছবিটিতে বনশ্রীর বিপরীতে নায়ক ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। কিন্তু ফারুক ঠাকুর এই
অচেনা মেয়েটির পেছনে কেন কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। এ নিয়ে চারদিকে তখন
নানা কানাঘুষা ছিল।
কেউ কেউ বলতেন, বনশ্রী ছিলেন ফারুক
ঠাকুরের বিবাহিতা স্ত্রী। কেউ বলতেন প্রেমিকা। তবে এ নিয়ে তারা কখনও কোনো
কথা বলেননি। ফারুক ঠাকুরের ইউনিটের সকলে বনশ্রীকে সমীহ করে কথা বলতেন। তিনি
চেয়েছিলেন বনশ্রী হবে এদেশের প্রথম সারির একজন নায়িকা। এজন্য তাকে যতো
টাকা ব্যয় করতে হয়, তা তিনি করবেন। তবে তিনি নিজ বলয়ের বাইরে কারও ছবিতে
কাজ করতে দিতেন না বনশ্রীকে। এই নিয়ে বনশ্রীর মনে ক্ষোভ থাকলেও ফারুক
ঠাকুরের ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। তাই বনশ্রীর পক্ষে সীমিত কয়েকটি ছবির
বেশি করা হয়নি। বনশ্রীর মুক্তি পাওয়া আর দুটি ছবি হলো নেশা ও মহাভূমিকম্প।
নির্মাণাধীন ছবি ছিল প্রেম বিসর্জন, নিষ্ঠুর দুনিয়া ও ভাগ্যের পরিহাস। এ
ছবিগুলো কখনই আলোর মুখ দেখেনি।
বনশ্রী থাকতেন মোহাম্মদপুরের একটি আলিশান বাড়িতে। বিলাসিতারও কোনো কমতি ছিল না।
এতো সুখ হয়তো তার ভাগ্যে সয়নি। ফারুক
ঠাকুর এবং বনশ্রীর সম্পর্ক যখন বেশ রমরমা তখনই ঘটে দুর্ঘটনাটি। গুলশান
এলাকার একটি জমি নিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে ফারুক ঠাকুরের মত বিরোধ ছিল। একদিন
তিনি বনশ্রীকে নিয়ে গুলশান যান। ওই জমিটি বনশ্রীর নামে লিখে দেওয়ার কথা ছিল
বলে তখন শোনা গিয়েছিল। জমিতে তারা পৌঁছুতেই সেখানে আসেন বিরোধী পক্ষ।
বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ফারুক ঠাকুর প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে
অকুস্থলেই মারা যান একজন । সেখান থেকে বনশ্রীকে ফেলে তিনি পালিয়ে যান। সেই
যে ফারুক ঠাকুর পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান সেখান থেকে আজ পর্যন্ত তিনি আর
প্রকাশ্যে আসেননি। সে সময়ে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সহযোগিতা পেয়েছিলেন
বলে তিনি আর গ্রেপ্তার হননি বলে গুঞ্জন ছিল।
এরপর থেকেই শুরু হয় বনশ্রীর জীবন যুদ্ধ।
ফারুক ঠাকুরের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে কোনো নির্মাতা বনশ্রীকে ছবিতে নেওয়ার
ব্যাপারে আগ্রহী হননি। ঠাকুরবিহীন বনশ্রী এরপর ধানমণ্ডিতে একটি বিউটি
পার্লার করেন। সে ব্যবসাও তিনি বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
আবার নতুনভাবে শুরু হয় তার জীবন যুদ্ধ। এ
সময়ে তার পরিচয়ের পরিধি বাড়তে থাকে দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে।
একজন বাঘা ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের সঙ্গে তার কেটে যায় অনেকদিন। এ সময় তিনি
মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের একটি বাড়িতে থাকতেন। এখানেও তিনি প্রাচুর্যের
জীবন যাপন করেছেন। তবে আগের তুলনায় কম। পরিবর্তমান সময়ে তার কোনো জীবনই
বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তার দুঃখের দিন শুরু হওয়ার পরপরই পরিবারের লোকজন
ক্রমশ সরে যেতে শুরু করেন তার পাশ থেকে।
অসহায় হয়ে পড়ার পর তিনি বিয়ে করেন। একটি
সন্তান হওয়ার পর স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। জীবিকা নির্বাহের সকল পথ বন্ধ
হয়ে যাওয়ার পর সন্তানটিকে কোলে নিয়ে শুরু হয় তার ভিক্ষাবৃত্তির জীবন।
ভিক্ষা করতে গিয়ে ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে তার দেখা হয় বেশ কয়েকটি ফিল্ম
ইউনিটের সঙ্গেও। কিন্তু এখন যারা ফিল্মে কাজ করেন তারাতো বনশ্রীকে চেনার
কথা নয়। তারপরও তিনি ইউনিটের আশপাশে ঘুরাঘুরি শুটিং দেখতেন, আর নিজেকে
মিলিয়ে নিতেন সংশ্লিষ্ট ছবির নায়িকার সঙ্গে নিজের পর্দা জীবন।
অসহায় এই জীবন যাপনের সময় তিনি ঢাকা
রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গেছেন যদি সেখানে অতীতের পরিচিত কোনো সাংবাদিককে
পাওয়া যায়। কাউকে পাওয়া গেলে তিনি নিজের দূরবস্থার কথা জানান দেবেন। তাদের
কাছে সাহায্য চাইবেন। তারা অসহায় জীবনের দিকে তাকিয়ে কেউ কি কোনো উপকার
করবে না তার? না, লাভ হয়নি। শূন্য হাতে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে গেছেন শেখের
টেকের বর্তমান বস্তি বাড়িটিতে। অনাহার আর অর্ধাহারে থাকতে থাকতে শেষ
পর্যন্ত একজনের পরামর্শে গাড়িতে বই বিক্রির কাজ শুরু করেছেন। এভাবেই চলছে
তার বর্তমান জীবন।
মনে পড়লো তার নির্মাণাধীন ছবি তিনটির নাম।
প্রেম বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পর এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় শুরু হয়েছে তার ইতর
প্রাণীর মতো অস্তিত্ব টিকিয়ে যুদ্ধ। একি ভাগ্যের পরিহাস? সূত্র: আমাদের সময়
http://www.newsevent24.com/2013/09/20/%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE-%E0%A6%8F%E0%A6%96%E0%A6%A8/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন