রাজধানীতে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ : ককটেল বিস্ফোরণ ও বাস ডিপোতে আগুন
28 Oct, 2013
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮
দলের ডাকা টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক
সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে ফরিদপুর, যশোর, পাবনা, পিরোজপুরে সরকার ও
বিরোধী দলের পাঁচ কর্মী নিহত ও কয়েক হাজার নেতাকর্মী আহত হন। মহাজোট
সরকারের শেষ সময়ে রোববার বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বিশেষ করে জামায়াত-শিবির
রাজপথে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। রাজধানীতে বিপুল
পরিমাণ ককটেলের বিস্ফোরণ, গাবতলীর বিআরটিসি বাস ডিপোসহ শহরের অনেক জায়গায়
যানবাহনে ও নিু আদালত ভবনের নথি রাখার কক্ষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাজধানীতে
র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সক্রিয় থাকলেও এসব সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে
রাখতে পারেনি। অনেক এলাকায় হরতাল সমর্থক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলেছে। ছোড়া হয়েছে টিয়ার গ্যাস শেল আর রাবার
বুলেট। হরতাল সমর্থকদের চোরাগোপ্তা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় তাদের সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ড মোকাবেলা করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশ বেগ পেতে হয়।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আজ রাজধানীসহ সারা দেশে সংঘর্ষ ও সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়তে পারে। এ লক্ষ্যে জামায়াত-শিবির ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ২০০৬ সালের এই দিনে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে জামায়াতের বেশ কয়েকজন কর্মী মারা যান। জামায়াতের দাবি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা দিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। প্রতি বছর এই দিনটিকে তারা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। সূত্র জানায়, দলের নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে আজ ব্যাপক সহিংসতার প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। দলের নীতিনির্ধারকদের নির্দেশ পেলে চালানো হতে পারে এই অপারেশন।
রোববারের হরতালে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও বরাবরের মতোই রাজপথে দেখা যায়নি বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ কোনো নেতাকে। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল আর জামায়াত-শিবিরই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব সহিংসতায় মূল ভূমিকা পালন করে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করে।
হরতালের আগের রাতে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। ঢাকা ছাড়াও আশুলিয়া, টঙ্গী, কাঁচপুরে অর্ধশত যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও শতাধিক গাড়ি ভাংচুর করা হয়। এছাড়া শনিবার সকাল থেকে রাজধানীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাসা লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। রাতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পরও হরতাল প্রত্যাহার না করায় পুরো ঢাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
হরতাল সমর্থকদের এমন আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। যার প্রভাব হরতালের প্রথম প্রহরেই লক্ষ্য করা যায়। আগেকার যে কোন হরতালের চেয়ে রোববার রাজধানীর সড়কে যানবাহনের সংখ্যা ছিল খুবই কম। হাতেগোনা কিছু লোকাল বাস, অটোরিকশা চলতে দেখা গেছে। ভিআইপিসহ বেশির ভাগ সড়কই ছিল রিকশার দখলে। শপিংমলসহ দোকানপাট ছিল বন্ধ। রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। অনেক জায়গায় ট্রেনে আগুন দেয়া হলেও লঞ্চ ও বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সরকারি অফিস আদালতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল কম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও কোনো পরীক্ষা ও ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়নি।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় ফাঁকা : বিগত হরতালের মতোই নেতাকর্মীশূন্য ছিল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। শনিবার রাত থেকেই নয়াপল্টন ও আশপাশের অলিগলির সামনে র্যাব-পুলিশ অবস্থান নেয়। প্রস্তুত রাখা হয় রায়টকার, জলকামান। ফকিরাপুল থেকে নাইটএঙ্গেল মোড়ের রাস্তায় কোনো ব্যারিকেড না দেয়ায় সিএনজিসহ রিকশা চলাচল করে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া না হলেও সারাদিনে তেমন কেউ সেখানে যায়নি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, মহানগর সদস্য সচিব আবদুস সালাম, বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি, শামীমুর রহমান শামীম, আসাদুল করিম শাহীন, বেলাল আহমেদ, আশরাফুর রহমান, আমিনুল ইসলামসহ ১৫-২০ জন নেতাকর্মী সকাল থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করেন।
সারাদিন নিরুত্তাপ থাকলেও পড়ন্ত বিকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বিপরীত দিকে পরপর দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে খানিকটা উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। বিকাল ৫টার দিকে নাইটএঙ্গেল মোড়ে বিস্ফোরিত হয় আরও ১টি ককটেল।
এদিকে সকালে কাকরাইল মসজিদসংলগ্ন রাস্তায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে নিজের শরীরের অংশবিশেষ ঝলসে গেছে সুমন নামে এক যুবকের। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। রমনা থানার উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম জানান, সুমন কাকরাইল মসজিদ সংলগ্ন রাস্তায় বিস্ফোরণের উদ্দেশ্যে একটি ককটেল ছোড়ে। কিন্তু ককটেলটি তার হাতেই বিস্ফোরিত হয়ে হাত, পেট ও ডান পা ঝলসে যায়। তার অবস্থা আশংকাজনক।
গাবতলী-মিরপুর-শ্যামলী-মোহাম্মদপুর : রোববার ভোরে রাজধানীর গাবতলী বিআরটিসি বাস ডিপোতে দুর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ডিপোতে থাকা দুটি বাস পুরোপুরি পুড়ে গেছে। দারুস সালাম থানা পুলিশ এ ঘটনায় দুজনকে আটক করেছে। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে জানান, অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, সন্দেহ করা হচ্ছে, বিআরটিসির কোনো কর্মচারী এতে জড়িত। তিনি বলেন, ডিপোর পাশে উঁচু দেয়াল আছে তা টপকে বাইরের কারও পক্ষে আগুন দেয়া কঠিন। এ কারণে সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ ঘটনাস্থল এসে একজন চালককে পায়। তকেও নিয়ে যায়। কিন্তু ওই চালক ও নিরাপত্তাকর্মী ডিপোর আগুন থেকে রক্ষা করতে একটি একটি করে গাড়ি রাস্তায় নিয়ে আসে। ডিপোর ব্যবস্থাপক আব্দুর রহিম জানান, দুর্বৃত্তরা ভোরে দেয়াল টপকে বাসগুলোতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ৬টি দোতলা বাস আগুন লাগলেও দুটি পুড়ে যায়। মিরপুর বেড়িবাঁধে পাবনা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। ভোর ৫টার দিকে ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোডের আবাহনী মাঠের কাছে ৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এদিকে শাহ আলী মাজার রোডের দ্বিতীয় কলোনিতে হাতবোমা বিস্ফোরণের সময় পুলিশ হাতেনাতে দুই দুর্বৃত্তকে আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে।
মিরপুরে ভোর সোয়া ৬টার দিকে প্রশিকা ভবনের মোড়ে ব্যানার নিয়ে মিছিল করে যুবদল, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। পুলিশ মিছিলকারীদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশ ফাঁকা গুলি চালিয়ে আতংক ছড়ায়। পরে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৩ জনকে আটক করে পুলিশ। মিরপুর থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান জানান, আটক হওয়া ব্যক্তিরা ওই এলাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাত। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পেট্রোল বোমা ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে। ভোর ৬টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বেসরকারি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের গলিতে ব্যানার হাতে মিছিল করে হরতাল সমর্থকরা। সেখানে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। তবে সেখান থেকে কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। শ্যামলী রিংরোডে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পরপর চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সামনে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। একটি মোটরসাইকেলে চলন্ত অবস্থায় দুজন যুবক কমিশনের গেটে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে। ঘটনার পর তেজগাঁও পুলিশের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সেখানে যান। পরে গেটে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
হরতালের সমর্থনে মিরপুরে সনি সিনেমা হলের কাছে মিছিল করেছে ছাত্রদল। এ সময় কে বা কারা দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। পুলিশ মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি চালায়। এতে একজন কর্মী আহত হন। মোহাম্মদপুরে হরতালের সমর্থনে মিছিল করেছে যুবদল ও ছাত্রদল নেতারা। হরতাল চলাকালে এসব এলাকায় মানুষের মাঝে ছিল চরম উদ্বেগ আর আতংক। রাস্তায় কিছু যান চলাচল থাকলেও মানুষের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। হরতাল চলাকালে রাজধানীর পল্লবী, গাবতলীর মাজার রোড, কালশি রোড, মিরপুর ১৪ নম্বর, মিরপুর ১ নম্বর চাইনিজ এলাকা, পাইকপাড়া, টেকনিক্যাল মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ককটেল ফাটানো হয়।
সংসদ ভবন : সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপির সংসদ সদস্যরা হরতাল সমর্থনে মিছিল করেন। এর আগে সকাল ৭টার দিকে ইন্দিরা রোডে হরতাল সমর্থনে ১০-১২ জন একটি মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের নিচে সকাল থেকেই হরতালের বিপক্ষে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা হরতালবিরোধী একটি মিছিল করে কারওয়ান বাজার এলাকায়। এছাড়া ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও বাংলামোটর এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই হরতাল পালিত হয়েছে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট সড়কে যান চলাচল ছিল খুবই কম। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। সকাল থেকেই পুলিশের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।
মগবাজার-মালিবাগ-খিলগাঁও-শান্তিনগর : মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও ও শান্তিনগর এলাকায় শনিবার রাত থেকেই আতংক দেখা দেয়। ভোর থেকেই এসব এলাকায় টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে আসছিল। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তার পাশাপাশি বিজিবিকে রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে। এ সময় হরতাল সমর্থনকারীরা বেশ কয়েকটি মিছিল বের করে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পল্লীমা সংসদের সামনে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে। পুলিশ ধাওয়া দিলে মিছিলকারীরা কয়েকটি ককটেল নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। একই সময় চৌধুরীপাড়া আবুল হোটেলের সামনে ইসলামী ছাত্রশিবির মিছিল বের করে কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। পুলিশ এলে মিছিলকারীরা পালিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ৮টায় মগবাজার এলাকায় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি মিছিল বের করে। পুলিশ বাধা দিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ভোরে শান্তিনগরে ছাত্রশিবির মিছিল বের করলে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করে। একই সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন খিলগাঁও অঞ্চল-২ এ ককটেল বিস্ফোরণে আনোয়ার উদ্দিন (৪২) নামে এক কর্মচারী আহত হয়েছেন। আনোয়ার ডিসিসিতে স্প্রেম্যান পদে কর্মরত।
হরতালের কারণে ওইসব এলাকায় দোকানপাট তেমন একটা খোলা ছিল না। এলাকায় রিকশা চলাচল ছিল প্রায় স্বাভাবিক। ফুটপাতের দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতা ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক কম। রিকশার পাশাপাশি কিছু বাস চলাচল করেছে রাস্তায়। অন্যান্য হরতালের তুলনায় গতকাল প্রাইভেট কার চলাচল করেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বন্ধ। রাস্তায় পুলিশের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মাঝে মধ্যে পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন দিতে দেখা গেছে। পুলিশের এপিসি রাস্তায় টহল দেয় সার্বক্ষণিক।
যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ-শ্যামপুর : সকাল সাড়ে ৭টায় যাত্রাবাড়ীতে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতাল সমর্থনকারীরা। এই কার্যালয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়েছে। খবর পেয়ে দমকল কর্মী ও পুলিশ এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তাছাড়া দনিয়ায় ইসলামী ছাত্রশিবির মিছিল বের করে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। দুপুর ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী ধোলাইপাড় এলাকায় হরতাল সমর্থনকারীরা প্রায় ১০টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দোকানপাটসহ যানবাহন ভাংচুর করার চেষ্টা করে। এদিকে হরতালের কারণে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে দূরপাল্লার কোনে বাস ছেড়ে যায়নি।
হরতাল শুরুর প্রায় দু’ঘণ্টা পর শ্যামপুর-কদমতলী থানা বিএনপির সভাপতি মীর হোসেন মীরুর নেতৃত্বে জুরাইন মুন্সীবাড়ী এলাকা থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি জুরাইন-দয়াগঞ্জ সংযোগ সড়ক ধরে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশনের দিকে এগোতে থাকলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলকারীরা। অন্যদিকে জুরাইন রেলগেটের কাছে স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানমের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী মিছিল হয়। বেলা সোয়া ১১টায় হতালবিরোধী আরেকটি মিছিল হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মনির হোসেন স্বপনের নেতৃত্বে। হরতাল চলাকালে শ্যামপুরের প্রধান সড়ক সংলগ্ন দোকানপাট বন্ধ ছিল। সিটি সার্ভিসের কোন বাস চলাচল করেনি। তবে প্রচুর রিকশা চলাচল করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা : হরতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কারও হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া হরতাল চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় বিএনপি সমর্থকদের কোনো ধরনের মিছিল অথবা পিকেটিং করতে দেখা যায়নি। তবে ছাত্রলীগ সকাল থেকেই এ এলাকায় ছিল তৎপর। বিএনপি-জামায়াতের কোনো কর্মসূচি এ এলাকায় না দেখা গেলেও ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কড়া নিরাপত্তার কারণে মিছিল পিকেটিং না করতে পেরে রাজধানীর আজিমপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। এ সময় তারা কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে এবং পরপর চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলের সামনে বেলা ১১টার দিকে পরপর চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় হরতাল সমর্থকদের দেখা না গেলেও সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সকাল থেকেই এ এলাকায় ছিল তৎপর। তারা দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের কাছে গিয়ে শেষ করে। এ সময় তারা প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে দলীয় নেতাকর্মীদের অবস্থানের জন্য নির্দেশ দেন এবং আগামী ২৯ তারিখ হরতালবিরোধী মিছিলেরও ঘোষণা দেন।
ককটেল ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার : ১৮ দলের ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালের আজিমপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের কোয়ার্টারের বাথরুম থেকে বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার বেলা সোয়া ১২টার দিকে লালবাগ থানা পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসব দ্রব্য উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, উদ্ধার করা বিস্ফোরকের মধ্যে ১৭টি হাতবোমা, আধা কেজি গানপাউডার রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, উদ্ধারকৃত আধা কেজি গানপাউডার দিয়ে প্রায় ১০০ বোমা তৈরি করা সম্ভব। জানা যায়, ঢাবির ল’ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী বিসু চন্দ্র দাস নামে কোয়ার্টারের চতুর্থ তলায় বরাদ্দকৃত কক্ষটিতে প্রবেশ করার সময় সন্দেহ হলে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পুলিশ সেখানে গিয়ে রুম তালাবদ্ধ দেখে। পরে পুলিশ তালা ভেঙে সেখানে গিয়ে বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো উদ্ধার করে। কক্ষটি এর আগে খোরশেদ আলমের নামে বরাদ্দ ছিল। তিনি সেখান থেকে আড়াই মাস আগে চলে যান।
চারুকলার সামনে বিস্ফোরণ : এছাড়া সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে পরপর দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকা : হরতালে রাজধানীর নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকায় যান চলাচল ছিল একেবারে সীমিত। এসব এলাকার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এছাড়া ফুটপাতের কয়েকটি দোকান ছাড়া নিউমার্কেট, রাফিন প্লাজা, বলাকা ও চাঁদনী চক শপিংমল, গাউছিয়া মার্কেট, চন্দি মা সুপার মার্কেট, নূরজাহান মার্কেটসহ এই এলাকার সব দোকানপাটই বন্ধ ছিল।
সিএমএম কোর্টে আগুন : সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুরান ঢাকার নয়াবাজারের বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ১টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার আগেই তারা পালিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে থেকে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। ছাত্রদল নেতা কাজল ও মাসুমের নেতৃত্বে বের হওয়া মিছিলটি লক্ষ্মীবাজারের দিকে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। এ সময় ছাত্রদল কর্মীরা পরপর ৩টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে তাঁতীবাজার মোড়ে পরপর ২টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নয়াবাজরের মহানগর হাসপাতালের সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলে চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। সাড়ে ১১টার দিকে ধোলাইখাল এলাকায় হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে যুবদলের কর্মীরা। পরে পুলিশ ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। পৌনে ১২টার দিকে বাংলাবাজারের প্যারিদাস লেন এলাকায় হরতালের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল বের করে শিবিরকর্মীরা। ঘটনাস্থলে পুলিশ আসার আগেই তারা বিভিন্ন গলি দিয়ে পালিয়ে যায়। দুপুর ১২টার দিকে বংশালে হরতাল সমর্থকরা একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতংক সৃষ্টি করে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একজনকে আটক করে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুরান ঢাকার সুরিটোলায় ১টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় হরতাল সমর্থকরা। একই এলাকায় বিকাল পৌনে ৫টার দিকে আরও একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটনায় দুর্বৃত্তরা।
এর আগে বেলা পৌনে ২টার দিকে ঢাকা সিএমএম আদালতের পুরনো ভবনে অবস্থিত নন জিআর সেকশনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে প্রায় আড়াইশ’ নথিপত্র পুড়ে যায়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি কেরোসিনের বোতল উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সামনে বেলা ২টায় ১টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলে পুরো এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে রাত সাড়ে ৭টায় লক্ষ্মীবাজার এলাকায় পরপর ৮-১০টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এখান থেকে পুলিশ ২ জনকে আটক করে।
হরতাল চলাকালে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যানবাহন চলাচল অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক কম ছিল। অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও যাত্রী সংখ্যা ছিল কম। হরতালের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরান ঢাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।
এদিকে হরতালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ, ঘাট শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা।
শেকৃবিতে হরতাল সমর্থনে সাদা দলের শিক্ষকদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন : বিশ্ববিদ্যালয়ে সব দলের সহাবস্থানের দাবিতে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ৬০ ঘণ্টা হরতাল সমর্থনে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) বিএনপিপন্থী সাদা দলের শিক্ষকরা ক্লাস, পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছেন। রোববার বেলা ১১টায় তারা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন এবং উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দর্শনার্থীশূন্য সচিবালয় : সকাল থেকেই ফাঁকা। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা। নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে দর্শনার্থী ছাড়াও সচিবালয়ের কর্মরত লোকজনকে বেগ পোহাতে হয়েছে সচিবালয়ে প্রবেশ করতে। সচিবালয়ের ভেতরের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ব্যস্তময় সচিবালয় ছিল অনেকটা দর্শনার্থী ও কর্মব্যস্তহীন পরিবেশ।
টানা ৬০ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিন সচিবালয়ে গিয়ে এ পরিস্থিতি দেখা গেছে। অন্যান্য দিনে দর্শনার্থীর ভিড় সকাল থেকেই লেগে থাকে। কিন্তু হরতালের দিন বাইরে সাধারণ মানুষ চলাচল কম থাকায় সচিবালয়ে অনেকে আসেনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পূর্বনির্ধারিত কিছু বৈঠক থাকলেও যথারীতি হয়েছে। তবে বৈঠকগুলোতে ছিল উপস্থিতি কম।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আজ রাজধানীসহ সারা দেশে সংঘর্ষ ও সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়তে পারে। এ লক্ষ্যে জামায়াত-শিবির ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ২০০৬ সালের এই দিনে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে জামায়াতের বেশ কয়েকজন কর্মী মারা যান। জামায়াতের দাবি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা দিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। প্রতি বছর এই দিনটিকে তারা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। সূত্র জানায়, দলের নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে আজ ব্যাপক সহিংসতার প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। দলের নীতিনির্ধারকদের নির্দেশ পেলে চালানো হতে পারে এই অপারেশন।
রোববারের হরতালে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও বরাবরের মতোই রাজপথে দেখা যায়নি বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ কোনো নেতাকে। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল আর জামায়াত-শিবিরই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব সহিংসতায় মূল ভূমিকা পালন করে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করে।
হরতালের আগের রাতে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। ঢাকা ছাড়াও আশুলিয়া, টঙ্গী, কাঁচপুরে অর্ধশত যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও শতাধিক গাড়ি ভাংচুর করা হয়। এছাড়া শনিবার সকাল থেকে রাজধানীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাসা লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। রাতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পরও হরতাল প্রত্যাহার না করায় পুরো ঢাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
হরতাল সমর্থকদের এমন আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। যার প্রভাব হরতালের প্রথম প্রহরেই লক্ষ্য করা যায়। আগেকার যে কোন হরতালের চেয়ে রোববার রাজধানীর সড়কে যানবাহনের সংখ্যা ছিল খুবই কম। হাতেগোনা কিছু লোকাল বাস, অটোরিকশা চলতে দেখা গেছে। ভিআইপিসহ বেশির ভাগ সড়কই ছিল রিকশার দখলে। শপিংমলসহ দোকানপাট ছিল বন্ধ। রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। অনেক জায়গায় ট্রেনে আগুন দেয়া হলেও লঞ্চ ও বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সরকারি অফিস আদালতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল কম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও কোনো পরীক্ষা ও ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়নি।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় ফাঁকা : বিগত হরতালের মতোই নেতাকর্মীশূন্য ছিল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। শনিবার রাত থেকেই নয়াপল্টন ও আশপাশের অলিগলির সামনে র্যাব-পুলিশ অবস্থান নেয়। প্রস্তুত রাখা হয় রায়টকার, জলকামান। ফকিরাপুল থেকে নাইটএঙ্গেল মোড়ের রাস্তায় কোনো ব্যারিকেড না দেয়ায় সিএনজিসহ রিকশা চলাচল করে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া না হলেও সারাদিনে তেমন কেউ সেখানে যায়নি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, মহানগর সদস্য সচিব আবদুস সালাম, বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি, শামীমুর রহমান শামীম, আসাদুল করিম শাহীন, বেলাল আহমেদ, আশরাফুর রহমান, আমিনুল ইসলামসহ ১৫-২০ জন নেতাকর্মী সকাল থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করেন।
সারাদিন নিরুত্তাপ থাকলেও পড়ন্ত বিকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বিপরীত দিকে পরপর দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে খানিকটা উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। বিকাল ৫টার দিকে নাইটএঙ্গেল মোড়ে বিস্ফোরিত হয় আরও ১টি ককটেল।
এদিকে সকালে কাকরাইল মসজিদসংলগ্ন রাস্তায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে নিজের শরীরের অংশবিশেষ ঝলসে গেছে সুমন নামে এক যুবকের। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। রমনা থানার উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম জানান, সুমন কাকরাইল মসজিদ সংলগ্ন রাস্তায় বিস্ফোরণের উদ্দেশ্যে একটি ককটেল ছোড়ে। কিন্তু ককটেলটি তার হাতেই বিস্ফোরিত হয়ে হাত, পেট ও ডান পা ঝলসে যায়। তার অবস্থা আশংকাজনক।
গাবতলী-মিরপুর-শ্যামলী-মোহাম্মদপুর : রোববার ভোরে রাজধানীর গাবতলী বিআরটিসি বাস ডিপোতে দুর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ডিপোতে থাকা দুটি বাস পুরোপুরি পুড়ে গেছে। দারুস সালাম থানা পুলিশ এ ঘটনায় দুজনকে আটক করেছে। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে জানান, অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, সন্দেহ করা হচ্ছে, বিআরটিসির কোনো কর্মচারী এতে জড়িত। তিনি বলেন, ডিপোর পাশে উঁচু দেয়াল আছে তা টপকে বাইরের কারও পক্ষে আগুন দেয়া কঠিন। এ কারণে সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ ঘটনাস্থল এসে একজন চালককে পায়। তকেও নিয়ে যায়। কিন্তু ওই চালক ও নিরাপত্তাকর্মী ডিপোর আগুন থেকে রক্ষা করতে একটি একটি করে গাড়ি রাস্তায় নিয়ে আসে। ডিপোর ব্যবস্থাপক আব্দুর রহিম জানান, দুর্বৃত্তরা ভোরে দেয়াল টপকে বাসগুলোতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ৬টি দোতলা বাস আগুন লাগলেও দুটি পুড়ে যায়। মিরপুর বেড়িবাঁধে পাবনা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। ভোর ৫টার দিকে ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোডের আবাহনী মাঠের কাছে ৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এদিকে শাহ আলী মাজার রোডের দ্বিতীয় কলোনিতে হাতবোমা বিস্ফোরণের সময় পুলিশ হাতেনাতে দুই দুর্বৃত্তকে আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে।
মিরপুরে ভোর সোয়া ৬টার দিকে প্রশিকা ভবনের মোড়ে ব্যানার নিয়ে মিছিল করে যুবদল, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। পুলিশ মিছিলকারীদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশ ফাঁকা গুলি চালিয়ে আতংক ছড়ায়। পরে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৩ জনকে আটক করে পুলিশ। মিরপুর থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান জানান, আটক হওয়া ব্যক্তিরা ওই এলাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাত। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পেট্রোল বোমা ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে। ভোর ৬টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বেসরকারি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের গলিতে ব্যানার হাতে মিছিল করে হরতাল সমর্থকরা। সেখানে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। তবে সেখান থেকে কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। শ্যামলী রিংরোডে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পরপর চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সামনে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। একটি মোটরসাইকেলে চলন্ত অবস্থায় দুজন যুবক কমিশনের গেটে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে। ঘটনার পর তেজগাঁও পুলিশের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সেখানে যান। পরে গেটে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
হরতালের সমর্থনে মিরপুরে সনি সিনেমা হলের কাছে মিছিল করেছে ছাত্রদল। এ সময় কে বা কারা দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। পুলিশ মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি চালায়। এতে একজন কর্মী আহত হন। মোহাম্মদপুরে হরতালের সমর্থনে মিছিল করেছে যুবদল ও ছাত্রদল নেতারা। হরতাল চলাকালে এসব এলাকায় মানুষের মাঝে ছিল চরম উদ্বেগ আর আতংক। রাস্তায় কিছু যান চলাচল থাকলেও মানুষের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। হরতাল চলাকালে রাজধানীর পল্লবী, গাবতলীর মাজার রোড, কালশি রোড, মিরপুর ১৪ নম্বর, মিরপুর ১ নম্বর চাইনিজ এলাকা, পাইকপাড়া, টেকনিক্যাল মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ককটেল ফাটানো হয়।
সংসদ ভবন : সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপির সংসদ সদস্যরা হরতাল সমর্থনে মিছিল করেন। এর আগে সকাল ৭টার দিকে ইন্দিরা রোডে হরতাল সমর্থনে ১০-১২ জন একটি মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের নিচে সকাল থেকেই হরতালের বিপক্ষে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা হরতালবিরোধী একটি মিছিল করে কারওয়ান বাজার এলাকায়। এছাড়া ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও বাংলামোটর এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই হরতাল পালিত হয়েছে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট সড়কে যান চলাচল ছিল খুবই কম। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। সকাল থেকেই পুলিশের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।
মগবাজার-মালিবাগ-খিলগাঁও-শান্তিনগর : মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও ও শান্তিনগর এলাকায় শনিবার রাত থেকেই আতংক দেখা দেয়। ভোর থেকেই এসব এলাকায় টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে আসছিল। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তার পাশাপাশি বিজিবিকে রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে। এ সময় হরতাল সমর্থনকারীরা বেশ কয়েকটি মিছিল বের করে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পল্লীমা সংসদের সামনে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে। পুলিশ ধাওয়া দিলে মিছিলকারীরা কয়েকটি ককটেল নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। একই সময় চৌধুরীপাড়া আবুল হোটেলের সামনে ইসলামী ছাত্রশিবির মিছিল বের করে কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। পুলিশ এলে মিছিলকারীরা পালিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ৮টায় মগবাজার এলাকায় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি মিছিল বের করে। পুলিশ বাধা দিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ভোরে শান্তিনগরে ছাত্রশিবির মিছিল বের করলে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করে। একই সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন খিলগাঁও অঞ্চল-২ এ ককটেল বিস্ফোরণে আনোয়ার উদ্দিন (৪২) নামে এক কর্মচারী আহত হয়েছেন। আনোয়ার ডিসিসিতে স্প্রেম্যান পদে কর্মরত।
হরতালের কারণে ওইসব এলাকায় দোকানপাট তেমন একটা খোলা ছিল না। এলাকায় রিকশা চলাচল ছিল প্রায় স্বাভাবিক। ফুটপাতের দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতা ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক কম। রিকশার পাশাপাশি কিছু বাস চলাচল করেছে রাস্তায়। অন্যান্য হরতালের তুলনায় গতকাল প্রাইভেট কার চলাচল করেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বন্ধ। রাস্তায় পুলিশের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মাঝে মধ্যে পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন দিতে দেখা গেছে। পুলিশের এপিসি রাস্তায় টহল দেয় সার্বক্ষণিক।
যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ-শ্যামপুর : সকাল সাড়ে ৭টায় যাত্রাবাড়ীতে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতাল সমর্থনকারীরা। এই কার্যালয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়েছে। খবর পেয়ে দমকল কর্মী ও পুলিশ এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তাছাড়া দনিয়ায় ইসলামী ছাত্রশিবির মিছিল বের করে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। দুপুর ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী ধোলাইপাড় এলাকায় হরতাল সমর্থনকারীরা প্রায় ১০টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দোকানপাটসহ যানবাহন ভাংচুর করার চেষ্টা করে। এদিকে হরতালের কারণে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে দূরপাল্লার কোনে বাস ছেড়ে যায়নি।
হরতাল শুরুর প্রায় দু’ঘণ্টা পর শ্যামপুর-কদমতলী থানা বিএনপির সভাপতি মীর হোসেন মীরুর নেতৃত্বে জুরাইন মুন্সীবাড়ী এলাকা থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি জুরাইন-দয়াগঞ্জ সংযোগ সড়ক ধরে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশনের দিকে এগোতে থাকলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলকারীরা। অন্যদিকে জুরাইন রেলগেটের কাছে স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানমের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী মিছিল হয়। বেলা সোয়া ১১টায় হতালবিরোধী আরেকটি মিছিল হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মনির হোসেন স্বপনের নেতৃত্বে। হরতাল চলাকালে শ্যামপুরের প্রধান সড়ক সংলগ্ন দোকানপাট বন্ধ ছিল। সিটি সার্ভিসের কোন বাস চলাচল করেনি। তবে প্রচুর রিকশা চলাচল করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা : হরতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কারও হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া হরতাল চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় বিএনপি সমর্থকদের কোনো ধরনের মিছিল অথবা পিকেটিং করতে দেখা যায়নি। তবে ছাত্রলীগ সকাল থেকেই এ এলাকায় ছিল তৎপর। বিএনপি-জামায়াতের কোনো কর্মসূচি এ এলাকায় না দেখা গেলেও ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কড়া নিরাপত্তার কারণে মিছিল পিকেটিং না করতে পেরে রাজধানীর আজিমপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। এ সময় তারা কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে এবং পরপর চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলের সামনে বেলা ১১টার দিকে পরপর চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় হরতাল সমর্থকদের দেখা না গেলেও সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সকাল থেকেই এ এলাকায় ছিল তৎপর। তারা দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের কাছে গিয়ে শেষ করে। এ সময় তারা প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে দলীয় নেতাকর্মীদের অবস্থানের জন্য নির্দেশ দেন এবং আগামী ২৯ তারিখ হরতালবিরোধী মিছিলেরও ঘোষণা দেন।
ককটেল ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার : ১৮ দলের ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালের আজিমপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের কোয়ার্টারের বাথরুম থেকে বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার বেলা সোয়া ১২টার দিকে লালবাগ থানা পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসব দ্রব্য উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, উদ্ধার করা বিস্ফোরকের মধ্যে ১৭টি হাতবোমা, আধা কেজি গানপাউডার রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, উদ্ধারকৃত আধা কেজি গানপাউডার দিয়ে প্রায় ১০০ বোমা তৈরি করা সম্ভব। জানা যায়, ঢাবির ল’ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী বিসু চন্দ্র দাস নামে কোয়ার্টারের চতুর্থ তলায় বরাদ্দকৃত কক্ষটিতে প্রবেশ করার সময় সন্দেহ হলে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পুলিশ সেখানে গিয়ে রুম তালাবদ্ধ দেখে। পরে পুলিশ তালা ভেঙে সেখানে গিয়ে বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো উদ্ধার করে। কক্ষটি এর আগে খোরশেদ আলমের নামে বরাদ্দ ছিল। তিনি সেখান থেকে আড়াই মাস আগে চলে যান।
চারুকলার সামনে বিস্ফোরণ : এছাড়া সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে পরপর দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকা : হরতালে রাজধানীর নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকায় যান চলাচল ছিল একেবারে সীমিত। এসব এলাকার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এছাড়া ফুটপাতের কয়েকটি দোকান ছাড়া নিউমার্কেট, রাফিন প্লাজা, বলাকা ও চাঁদনী চক শপিংমল, গাউছিয়া মার্কেট, চন্দি মা সুপার মার্কেট, নূরজাহান মার্কেটসহ এই এলাকার সব দোকানপাটই বন্ধ ছিল।
সিএমএম কোর্টে আগুন : সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুরান ঢাকার নয়াবাজারের বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ১টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার আগেই তারা পালিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে থেকে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। ছাত্রদল নেতা কাজল ও মাসুমের নেতৃত্বে বের হওয়া মিছিলটি লক্ষ্মীবাজারের দিকে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। এ সময় ছাত্রদল কর্মীরা পরপর ৩টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে তাঁতীবাজার মোড়ে পরপর ২টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নয়াবাজরের মহানগর হাসপাতালের সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলে চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। সাড়ে ১১টার দিকে ধোলাইখাল এলাকায় হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে যুবদলের কর্মীরা। পরে পুলিশ ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। পৌনে ১২টার দিকে বাংলাবাজারের প্যারিদাস লেন এলাকায় হরতালের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল বের করে শিবিরকর্মীরা। ঘটনাস্থলে পুলিশ আসার আগেই তারা বিভিন্ন গলি দিয়ে পালিয়ে যায়। দুপুর ১২টার দিকে বংশালে হরতাল সমর্থকরা একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতংক সৃষ্টি করে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একজনকে আটক করে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুরান ঢাকার সুরিটোলায় ১টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় হরতাল সমর্থকরা। একই এলাকায় বিকাল পৌনে ৫টার দিকে আরও একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটনায় দুর্বৃত্তরা।
এর আগে বেলা পৌনে ২টার দিকে ঢাকা সিএমএম আদালতের পুরনো ভবনে অবস্থিত নন জিআর সেকশনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে প্রায় আড়াইশ’ নথিপত্র পুড়ে যায়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি কেরোসিনের বোতল উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সামনে বেলা ২টায় ১টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলে পুরো এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে রাত সাড়ে ৭টায় লক্ষ্মীবাজার এলাকায় পরপর ৮-১০টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এখান থেকে পুলিশ ২ জনকে আটক করে।
হরতাল চলাকালে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যানবাহন চলাচল অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক কম ছিল। অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও যাত্রী সংখ্যা ছিল কম। হরতালের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরান ঢাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।
এদিকে হরতালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ, ঘাট শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা।
শেকৃবিতে হরতাল সমর্থনে সাদা দলের শিক্ষকদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন : বিশ্ববিদ্যালয়ে সব দলের সহাবস্থানের দাবিতে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ৬০ ঘণ্টা হরতাল সমর্থনে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) বিএনপিপন্থী সাদা দলের শিক্ষকরা ক্লাস, পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছেন। রোববার বেলা ১১টায় তারা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন এবং উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দর্শনার্থীশূন্য সচিবালয় : সকাল থেকেই ফাঁকা। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা। নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে দর্শনার্থী ছাড়াও সচিবালয়ের কর্মরত লোকজনকে বেগ পোহাতে হয়েছে সচিবালয়ে প্রবেশ করতে। সচিবালয়ের ভেতরের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ব্যস্তময় সচিবালয় ছিল অনেকটা দর্শনার্থী ও কর্মব্যস্তহীন পরিবেশ।
টানা ৬০ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিন সচিবালয়ে গিয়ে এ পরিস্থিতি দেখা গেছে। অন্যান্য দিনে দর্শনার্থীর ভিড় সকাল থেকেই লেগে থাকে। কিন্তু হরতালের দিন বাইরে সাধারণ মানুষ চলাচল কম থাকায় সচিবালয়ে অনেকে আসেনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পূর্বনির্ধারিত কিছু বৈঠক থাকলেও যথারীতি হয়েছে। তবে বৈঠকগুলোতে ছিল উপস্থিতি কম।
উৎসঃ যুগান্তর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন